স্বদেশ ডেস্ক:
দেশে করোনা সংক্রমণ আবার ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ২ হাজার ৮০৯ জন, যা গত ৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ সময়ে মারা গেছে ৩০ জন, যা ৮৩ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যা। গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় ২৫ হাজার ১১১টি নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে রোগী শনাক্ত হয়েছে ২ হাজার ৮০৯ জন। নমুনা পরীক্ষায় রোগী শনাক্তের হার ১১ দশমিক ১৯ শতাংশ। দেশে এর আগে গত বছরের ২০ আগস্ট ২ হাজার ৮৬৮ জন শনাক্তের খবর জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর পর থেকে শনাক্ত কমতে শুরু করে। এক পর্যায়ে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে
শনাক্ত ৩০০-এর মধ্যে নেমে আসে। হঠাৎ করে মার্চ থেকে করোনা রোগী বাড়তে থাকে। প্রায় ৭ মাস পর গতকাল সোমবার সর্বোচ্চ ২ হাজার ৮০৯ জন রোগী শনাক্ত হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে ৩০ জন, যা ৮৩ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত। এর আগে গত ২৯ ডিসেম্বর ৩০ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ওইদিনের পর থেকে মৃত্যু কমতে থাকে। একদিনে করোনায় মৃত্যু ১০ জনের নিচে নেমে এসেছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, করোনার সংক্রমণ দীর্ঘসময় ধরে চলছে। সংক্রমণ প্রতিরোধে মাস্কপরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এটি সরকার বা জনগণের একার পক্ষে সম্ভব হবে না, একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা নিতে হবে।
করোনার প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে গত বছর ৮ মার্চ; এর পর রোগী সংখ্যা ১ জুন ৫০ হাজারে; ১৮ জুন এক লাখে; ১ জুলাই দেড় লাখে; ১৭ জুলাই ২ লাখে এবং ২৫ আগস্ট ৩ লাখে পৌঁছায়। গতকাল পর্যন্ত শনাক্ত হয় ৫ লাখ ৭৩ হাজার ৬৮৭ জন। গত বছরের ২ জুলাই ৪ হাজার ১৯ জন রোগী শনাক্ত হয়, যা একদিনের সর্বোচ্চ শনাক্ত। প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর গত বছরের ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। দেশে গত বছরের ৩০ জুন একদিনেই ৬৪ জনের মৃত্যু হয়, যা একদিনের সর্বোচ্চ মৃত্যু।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্যমতে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা শুরু হয় চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি থেকে। করোনা পরীক্ষা শুরুর ৪৮ দিনের মাথায় গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম ৩ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এসব রোগী ছিল ঢাকা ও মাদারীপুর জেলার। প্রথমদিকে সংক্রমণ বেশি হওয়ায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও মাদারীপুরকে ক্লাস্টার এরিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সংক্রমণ রোধে ক্লাস্টার এরিয়া লকডাউন করে স্থানীয় প্রশাসন। লকডাউন করার পর ক্লাস্টার এরিয়া মাদারীপুরে সংক্রমণ বিস্তার বেশি না হলেও ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় সংক্রমণ বাড়তে থাকে। এর পর ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে মানুষ বিভিন্ন স্থানে গমণ করায় সেখানে সংক্রমণ ছড়াতে থাকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে করোনার সংক্রমণ বেশি হয়েছে জুন-জুলাই মাসে। ওই সময় দিনে ৪ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত এবং ৫০-৬০ জনের মৃত্যু হতো। কিছুদিন একই অবস্থায় থেকে আগস্ট মাসের শেষ দিকে করোনার সংক্রমণ কমতে শুরু করে। এর পর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে রোগী শনাক্তের হার ১০ শতাংশে নেমে আসে। শীতের আগমন ঘটার আগ থেকেই অর্থাৎ নভেম্বর থেকে সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করে এবং নভেম্বরে রোগী শনাক্তের হার ১৫ শতাংশ পৌঁছে। এর পর কিছুদিন সংক্রমণ উঠানামা করে ডিসেম্বরের শেষ দিকে আবার কমতে শুরু করে এবং জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সংক্রমণ হার ২ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে অবস্থান করে। কিন্তু মার্চ মাসের শুরু থেকে সংক্রমণ আবার বাড়তে থাকে।
ডা. আবু জামিল মো. ফয়সাল বলেন, সরকার মাস্কপরার কথা বলছে, কিন্তু মানুষ পরছে না। মানুষ কেন মাস্ক পরছে না সেটা খুঁজে দেখতে হবে। মানুষকে মাস্কপরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করতে হবে। সারাদেশে করোনার টেস্টিং কার্যক্রম বাড়াতে হবে। টেস্টিংয়ে যাদের পজিটিভ পাওয়া যাবে তাদের চিকিৎসা ও আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে। আর যারা পজিটিভ রোগীর সংস্পর্শে এসেছিলেন তাদের খুঁজে বের করে পরীক্ষা করতে হবে এবং কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে।
করোনার মাসভিত্তিক পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের ৮ মার্চ করোনা রোগী শনাক্তের থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময়ে নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ১ হাজার ৫১৫টি। এসব নমুনা পরীক্ষায় রোগী শনাক্ত হয়েছে ৫১ জন। একই সময়ে মারা গেছে ৫ জন এবং সুস্থ হয় ২৫ জন। নমুনা পরীক্ষায় রোগী শনাক্তের হার ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং সুস্থতার হার ৪৯ দশমিক ১০ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে ২১ থেকে ৪০ বছরের বয়সী মানুষ। এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ৫ লাখ ৭৩ হাজার ৬৮৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৭১ শতাংশ এবং নারী ২৯ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে করোনা সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে পুরুষের। মারা গেছে ৮ হাজার ৭২০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৬ হাজার ৫৯৫ জন, যা মোট মৃত্যুর ৭৫ দশমিক ৬৩ এবং নারী ২ হাজার ১২৫ জন, যা মোট মৃত্যুর ২৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, করোনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে বয়স্ক মানুষের। করোনায় মৃত্যুর প্রায় ৫৫ শতাংশের বেশি হচ্ছে ৬০ বছরের ঊর্র্ধ্বে। মৃতের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৬০ বছরের বেশি বয়সী ৪ হাজার ৮৭৫ জন, যা মোট মৃত্যুর ৫৫ দশমিক ৯১ শতাংশ।
মৃতের বিভাগভিত্তিক তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ঢাকায় আর কম ময়মনসিংহে। যারা মারা গেছে তার মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৪ হাজার ৯১৫ জন, যা মোট মৃত্যুর ৫৬.৩৬ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড-১৯ টিকা প্রদান কর্মসূচি গত ২৭ জানুয়ারি উদ্বোধন শুরু হয়। এর কয়েকদিন পর ৭ ফেব্রুয়ারি একযোগে টিকাদান কর্মসূচি চালু হয়। গতকাল পর্যন্ত সারাদেশে টিকা নিয়েছে ৪৯ লাখ ১১ হাজার ৯০২ জন। গত ২৭ জানুয়ারি টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধনের পরই সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মে টিকার নিবন্ধন শুরু করা হয়। ওইদিন থেকে গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন ৬২ লাখ ৮২ হাজার ৮৮৪ জন।